প্রায় দুই বছর সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছিল। এ সময় অনেক দেশের জিডিপি মাইনাসেও চলে গেছে। ভালো ছিল না আমদানি-রপ্তানির অবস্থা। তবে অবাক করার তথ্য হলো, এর মধ্যেও বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। তবে এই কোটিপতি ব্যাংকের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আমানত রাখার হিসাব অনুসারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি। এই সংখ্যাটা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য খুব ছোট নয়। কারণ ১৯৭২ সালে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫টি। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই হিসাব লাখ ছুঁই ছুঁই করছে (৯৯ হাজার ৯১৮টি)।
কিন্তু কেন বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা? এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেউ বলছেন, দেশে যেহেতু অর্থনীতি স্থবির ছিল, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়নি, তাই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। এটি অর্থনীতির স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।
আবার কেউ বলছেন, যে কারণেই কোটিপতির সংখ্যা বাড়ুক না কেন, এটি একটি দেশের আয় বৈষম্যের চরম উদাহরণ। দেশে কিছু মানুষ ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। কিছু মানুষ না খেয়ে মরছে। সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটি বড় বাধা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ছয় মাস আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোটি টাকার বেশি হিসাব ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। হিসাবগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
আর ছয় মাস পর অর্থাৎ জুনের মধ্যে কোটি টাকার হিসাব ৯৯ হাজার ৯১৮টি। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি। আর এসব হিসাবে আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট আমানতের প্রায় ৪৪ শতাংশই কোটিপতি হিসাব।
এছাড়া জুন শেষে দেশে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৬টি। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। তবে কোটি টাকার হিসাবে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছেন না। গুটিকয়েক ধনীর আয় বাড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় তুলনামূলক বাড়ছে না। এতে চরম আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।’
তবে বিষয়টি দুইভাবে দেখছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টিকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, দেশে কোটিপতি বৃদ্ধি হওয়ায় মনে হতে পারে দেশে ধনী বাড়ছে অর্থাৎ দেশ উন্নত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কোটিপতি বাড়ছে মানে আয়বৈষম্য বাড়ছে। কিছু মানুষ আরও গরিব হচ্ছে।’
তবে কোটিপতি বৃদ্ধির পেছনে দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাসের বিষয়টি উল্লেখ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষ ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করছে না। তখন সেই টাকা ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। এতে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দেশে বিনিয়োগের পরিস্থিতি ভালো থাকলে বিনিয়োগ হতো। সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হতো। ধনীদের মুনাফা হতো, নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ও বাড়তো। এখন ব্যাংকে টাকা থাকায় কর্মসংস্থান কম হচ্ছে। আয় বৈষম্য বাড়ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, এই সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা। ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা জমা রয়েছে ৭৮ হাজার ৬৯৪টি ব্যাংক হিসাবে। ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৭৩ হাজার ৮৭৫টি। ছয় মাসে এসব হিসাব বেড়েছে ৪ হাজার ৮১৯টি। ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ১১ হাজার ১৩টি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ৯ হাজার ৪২৬টি। ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির মধ্যে হিসাব জুন শেষে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫৯৯টি, ডিসেম্বরে যা ছিল ৩ হাজার ৫০৭টি।
এছাড়া ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে হিসাব ১ হাজার ৭৩২টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ১৮৫টি, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে ৮৩৯টি, ৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৫টি, ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ৩১৪টি, ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার ৫৯০টি ও ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাব সংখ্যা ১ হাজার ৫২৭টি রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় কোটিপতি হিসাব ছিল হতে গুনা কয়েকটি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে, কোটিপতি হিসাবের সংখ্যাও বড় হয়েছে। এর মধ্যে গত ১২ বছরে কোটিপতি বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা ছিল ৫টি, যা ১৯৭৫ সালে ৪৭টিতে উন্নীত হয়। এছাড়া দেশে কোটিপতি হিসাব ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮টি, ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি, ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩টি এবং ২০১৫ সালে ৫৭ হাজার ৫১৬টি।