প্রচ্ছদ আমার বাংলাদেশ মালা শাড়ী থেকে শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী: আমাদের একজন আনোয়ার হোসেন ছিলেন

মালা শাড়ী থেকে শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী: আমাদের একজন আনোয়ার হোসেন ছিলেন

0

দেশের পুরোনো উদ্যোক্তাদের একজন আনোয়ার হোসেন। অনেকেই তাঁকে মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন নামে চেনেন। ছোট থেকে শুরু করেছিলেন, এখন আনোয়ার গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী। আনোয়ার হোসেনের পরবর্তী প্রজন্ম এর হাল ধরেছে।

মালা শাড়ি, বাংলাদেশের শাড়ির জগতে প্রথম সুপরিচিত ব্র্যান্ড। দেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এই শাড়ি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিয়ে মানেই ছিল মালা শাড়ি। বাজারে তখন আমদানি করা এবং অবাঙালিদের কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন শাড়ি ছিল। সব শাড়িকে হটিয়ে বাজার দখল করে মালা শাড়ি।

মালা শাড়ির উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন। আজকের আনোয়ার গ্রুপ নামের যে বড় শিল্পগোষ্ঠী, আনোয়ার হোসেন তারই প্রতিষ্ঠাতা। দেশের কয়েকটি পুরোনো ও সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করলে আনোয়ার গ্রুপকে রাখতেই হবে।

আনোয়ার হোসেনদের পারিবারিক ব্যবসা অনেক পুরোনো। তবে তিনি নিজে পরিচিতি পেয়েছিলেন মালা শাড়ি দিয়ে। সবাই তাঁকে বলতেন, মালা শাড়ির আনোয়ার। ১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন আনোয়ার সিল্ক মিলস প্রতিষ্ঠা করে মালা শাড়ি বাজারে আনেন। গত শতাব্দীর আশির দশকেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় জিঙ্গেল ছিল ‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না’।

আনোয়ার গ্রুপ এখন বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বিমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপটির অধীনে কোম্পানি রয়েছে ২০টি।

অবশ্য এসব আনোয়ার হোসেনের মূল পরিচয় নয়। তাঁর পরিচয়, তিনি গুটিকয়েক বাঙালি উদ্যোক্তার একজন, যাঁদের হাতে বাংলাদেশের আজকের শিল্প–সক্ষমতা গড়ে উঠেছে।

আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৮ সালে। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার শুরু তারও ১০৪ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে। ওই বছর তখনকার কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে এক টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (আসল নাম লাট মিয়া)। এই ইজারার দলিলপত্র এখনো সংরক্ষিত আছে। ফলে এখন আনোয়ার হোসেনের পরিবারের ব্যবসার বয়স দাঁড়িয়েছে ১৮৩ বছর।

লাট মিয়ার মূল ব্যবসা ছিল শিং দিয়ে চিরুনি ও বোতাম তৈরি করে বিক্রি করা। আনোয়ার হোসেনের বাবার নাম রহিম বখ্স। তিনি (রহিম বখ্স) বাবার ব্যবসাকে বড় করেন। শিংয়ের চিরুনির পাশাপাশি কাপড়সহ আরও কিছু পণ্যের ব্যবসা করতেন তিনি। আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেছেন, ১৯৪৫ সালে ৮৫ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে রহিম বখ্স ছিলেন ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে চারজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একজন। বাকি তিনজন ছিলেন গফুর মহাজন, আফতাব উদ্দিন মহাজন ও মহিউদ্দিন খান মহাজন।

রহিম বখ্স পুরান ঢাকার আলমীগোলায় (লালবাগে) পরিবার নিয়ে বাস করতেন। যদিও আনোয়ার হোসেন দেশের স্বাধীনতার পরে ধানমন্ডিতে বসবাস করা শুরু করেন। আনোয়ার হোসেনের নিজের ব্যবসা শুরু ১৯৫৩ সালে। এর আগে কয়েক বছর তিনি পারিবারিক ব্যবসা সামলেছেন। ১৯৪৫ সালে আনোয়ার হোসেনের বাবার মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স সাত বছর। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা বিপাকে পড়ে যায়। বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজন টাকাপয়সা আত্মসাৎ করেন।

আনোয়ার হোসেনের মায়ের কাছে তাঁর বাবা রহিম বখ্স আট ইঞ্চি লম্বা আর তিন ইঞ্চি পুরুত্বের একটি সোনার ইট আর কিছু রুপার টাকা রেখে গিয়েছিলেন। অনেক বছর এ কথা মা সন্তানদের জানতে দেননি। কলসিতে ভরে মুরগির খোঁয়াড়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব পড়ে আনোয়ার হোসেনের ওপর। তার আগে তাঁর বড় ভাই তাঁকে নিজেদের দোকানের পাশে ভোলা মিঞা নামের এক ব্যক্তির দোকানে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পড়াশোনা, এরপর দোকানে কাজ। আনোয়ার হোসেনের ভাতা ছিল মাসে ১৫ টাকা। আর দৈনিক ২ আনা নাশতার খরচ।

একসময় বড় ভাই আনসার বাহিনীতে যোগ দিলে আনোয়ার হোসেনকেই ব্যবসা সামলাতে হয়। কিছুকাল পর বড় ভাই আবার ব্যবসায় ফিরে আসেন। আনোয়ার হোসেন নিজে কিছু করার চিন্তা শুরু করেন। ভোলা মিঞার দোকানে কাজ করে জমানো ৯০ টাকাই সম্বল। মা দিলেন ২০০ রুপার মুদ্রা, যা বিক্রি করে পাওয়া গেল ৩৯০ টাকা। মোট মূলধন ৪৮০ টাকায় ১৯৫৩ সালে চকবাজারে ২২০ নম্বর দোকান নিলেন তিনি। নাম দিলেন আনোয়ার ক্লথ স্টোর। বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর।

দোকান দেওয়ার পর আনোয়ার হোসেনকে কঠোর পরিশ্রম শুরু করতে হলো। ঢাকার রায়েরবাজারে তখন হাট বসত। সেখানে তিনি লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় করে নিয়ে যেতেন। পরনে লুঙ্গির ভাঁজে থাকত মুড়ি আর পেঁয়াজি। খিদে পেলে তাই খেতেন।

ব্যবসা বাড়তে থাকে। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি থেকে কাপড়, এরপর শাড়ি, ব্যবসা বাড়ছিল। আনোয়ার হোসেন নামেন ঢেউটিন আমদানির ব্যবসায়—সবই ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে। বাণিজ্যে ভালো করছিলেন ঠিকই, কিন্তু আনোয়ার হোসেনের ইচ্ছা ছিল শিল্পকারখানা করার। ১৯৫৬ সালে বাড়িতে শাড়ির ছাপাখানা চালু করেছিলেন। সেটা সেই অর্থে শিল্প ছিল না। ১৯৬৮ সালে তিনি একটি সিল্ক মিল কিনে নিয়ে চালু করলেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তৈরি হলো মালা শাড়ির ইতিহাস। তখন ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দোকান, কার্যালয়, বাড়ি-গাড়ি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতেও।

আনোয়ার হোসেন তাঁর আট দশকের জীবনে দুর্ভিক্ষ দেখেছেন, ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়া দেখেছেন, ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখেছেন। দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন (১৯৪৩ সালে) বাংলায় শুরু হয় দুর্ভিক্ষ।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ শেষবারের মতো যখন ঢাকায় আসেন, তখন আনোয়ার হোসেনের বয়স ১০ বছর। ঢাকার তখনকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর জনসভায় কিশোর আনোয়ার হোসেনও উপস্থিত ছিলেন, গিয়েছিলেন এলাকার নান্নু ভাইয়ের সঙ্গে। জিন্নাহ ভাষণ দিয়েছিলেন ইংরেজি আর উর্দুতে। যার বেশির ভাগই বুঝতে পারেননি আনোয়ার হোসেন। অবশ্য বুঝিয়ে দেন নান্নু ভাই।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আনোয়ার হোসেনের বয়স ৩৩ বছর। তিনি সে সময় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি উল্লেখ করেন, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রবের মতো ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। রাজনৈতিক নেতারা বা মুক্তিযোদ্ধারা যখনই যেতেন, যথাসম্ভব সহায়তা করতেন তিনি।

২৪ এপ্রিল চকবাজারে আগুন দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। পুড়ে যায় আনোয়ার হোসেনের দোকান। আগুন দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরে সিরাজ নামের এক ‘গুন্ডা’ এসে জানায়, তাঁর সব পণ্য পুড়ে যায়নি। আগুন দেওয়ার পর দোকান ভেঙে সিরাজ বেশ কিছু মালামাল উদ্ধার করে। মুক্তিযুদ্ধের আগে চকবাজারেই ৪২০ জন ব্যবসায়ীর কাছে ২০ লাখ টাকা পেতেন আনোয়ার হোসেন। সারা দেশে ৯টি গদিতে (বিক্রয়কেন্দ্র) মোট হাজারখানেক লোকের কাছে পাওনা ছিল। কেউ ফেরত দিয়েছেন, কেউ দেননি। অনেক পণ্যও খোয়া গেছে। কিন্তু আবার ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি।

দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বনামধন্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আজকের অবস্থানে আসার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল আনোয়ার হোসেনের। তিনি এবং সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান (এখন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ বা আইসিসিবির সভাপতি) মূলত সংগঠনটির অভিভাবক। তাঁরা দুজন আবার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাহবুবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, চাইলে আনোয়ার হোসেন অনেকবার ডিসিসিআইয়ের সভাপতি হতে পারতেন। কিন্তু হননি। বরং ১২ জনকে সভাপতি হতে সহায়তা করেছেন।

হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সংগঠনে সহায়তায় উদারহস্ত আনোয়ার হোসেন। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি সামাজিক কল্যাণে ভূমিকা রাখছে।

আনোয়ার হোসেন নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন, যার নাম আমার আট দশক। এই লেখায় যেসব উদ্ধৃতি ও তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনোটাই আনোয়ার হোসেনের নিজের মুখ থেকে শোনা নয়। তিনি স্মৃতিশক্তি হারানোর রোগ বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। রোগটি ধরা পড়ে ২০১২ সালে। দেশের খ্যাতিমান এই শিল্পপতি গত ১৯ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান। কবির ভাষায়, ‘এই যাওয়া প্রস্থান নয়, এই যাওয়া বার বার ফিরে ফিরে আসা।’ দেশের বরেণ্য এই শিল্পপতিকে বিনম্র শ্রদ্ধা…।

NO COMMENTS

আপনার মতামত প্রদান করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version