৯ বছর বয়সে ড্রামে করে তেল বিক্রি করা ছোট্ট শিশুটি আজ বাংলাদেশের গর্ব

0
510

জিরো থেকে হিরো হওয়ার যে গল্প আমরা বইয়ের পাতায় পড়ি, তার চমৎকার উদাহরণ সিটি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ফজলুর রহমান। প্রায় ৫০ বছর আগে দয়াগঞ্জ থকে ১৬ কেজি ওজনের তেলের টিন মাথায় করে নিয়ে বিক্রি করা ছোট্ট শিশুটি আজ বাংলাদেশের অন্যতম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। তার উৎপাদিত পণ্য নেই এমন কোনো বাংলার ঘর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এই অবস্থানে আশার পেছনে রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্প। এই দুটি জিনিস থাকলে যে যেকোনো মানুষ সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে তিনি তা করে দেখিয়েছেন।

মাত্র ৯ বছর বয়সে নিজের ওজনের সমান তেলের ড্রাম মাথায় নিয়ে দোকানে দোকানে ঘোরা ফজলুর রহমান দেখিয়ে দিয়েছেন, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ীও কোটিপতি হতে পারে। তাঁর জীবনের গল্প যেন স্বপ্নকেও হার মানায়।

ফজলুর রহমান জানান, বড় কিছু করার সাহস, পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা, দায়বদ্ধতাই তাঁকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় ‘সিটি অয়েল মিলস’-এর বাজারজাতকরণের মধ্য দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করেছিল, আজ তা দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘সিটি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’।

তেল, চিনি, আটা, ময়দা, সুজিসহ অনেক খাদ্যসামগ্রীই এখন তাঁর কারখানায় তৈরি হয়। মুরগি ও মাছের খাদ্যের বাজারেও তাঁর অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী। নিম্নমানের ভারতীয় পোলট্রি ও ফিশ ফিডে যখন বাজার ছেয়ে গিয়েছিল, দেশের খামারিরা জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন; তখনই তাঁদের হাতে মানসম্পন্ন বিকল্প তুলে দেন ফজলুর রহমান।

তাঁর এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বছরে চার হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে। দেশের প্রায় প্রত্যেক পরিবারে ব্যবহৃত হয় তাঁর প্রতিষ্ঠানের কোনো না কোনো পণ্য। ষাটের দশকে মাত্র ৪২ রুপি দিয়ে শুরু করেছিলেন মুদি দোকান। আজ বাংলাদেশের প্রায় প্রতি ঘরেই রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কোনো না কোনো খাদ্যসামগ্রী।

পড়াশুনো করার সুযোগ পাননি ছোটবেলায়। অবস্থাসম্পন্ন আত্দীয়স্বজনও বাড়াননি সাহায্যের হাত। বিশেষ করে যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মারাত্দক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ব্যবসা পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে উঠেছিল।

তবে সব বাধা পেরিয়ে ফজলুর রহমানের সিটি গ্রুপ আজ দেশের প্রথম সারির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আজ তাঁর চার ছেলেমেয়ের সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত। প্রথম দিকে ‘সিটি অয়েল মিলস’ স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য সরিষার তেল উৎপাদন করতে শুরু করে।

পরবর্তী ১৮ বছরে ঢাকা শহরকেন্দ্রিক বাজারে ব্যবসা চালায় তাঁর কম্পানি। বিপুল চাহিদার কারণে ধীরে ধীরে উৎপাদন ও মুনাফা বাড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা সম্প্রসারণে মনোযোগী হন ফজলুর রহমান। আজ তিনি ২১টি প্রতিষ্ঠানের মালিক। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ১৪ হাজার কর্মী। সিটি গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানও বটে।

বিশ্ব বাজারে সিটি গ্রুপের পণ্য তীর বনস্পতি ও তীর সয়াবিন তেলের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় কম্পানির রপ্তানি প্রতিবছরই বাড়ছে।

দেশ-বিদেশের বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই পূর্বপুরুষের হাত ধরে ব্যবসায় এসেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবসা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ফজলুর রহমানকে বড় হতে হয়েছে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টাটা বা বিড়লাদের মতো ব্যবসায়ীরা ছোট বেলায় বাবা-দাদার হাত ধরে কারখানায় ঘুরতে যেতেন। ছোটবেলা থেকেই ব্যবসা সম্পর্কে তাঁদের মাঝে ধারণা তৈরি হয়। আমি তো এ সুযোগ পাইনি। আমি যতটুকু করেছি, সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় করেছি।’

একজন উদ্যোক্তার সফল হওয়ার পেছনে যে বিষয়গুলো জড়িত, তার মধ্যে ব্যাংক ঋণ অন্যতম। ব্যবসা করার জন্য ব্যাংকের সহায়তা অপরিহার্য বলেই মনে করেন সিটি গ্রুপের কর্ণধার। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের সাপোর্ট (সহায়তা) ছাড়া, একক কমিটমেন্টে কারো পক্ষে সফল হওয়া খুব কঠিন। তবে যথাযথ ব্যাংকিং সাপোর্ট পেতে হলে আগে নিজের বা প্রতিষ্ঠানের গুডউইল (সুনাম) বাড়ানো প্রয়োজন।’

ব্যবসায় সাফল্য চাইলে সততা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার পাশাপাশি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মানও বজায় রাখা জরুরি_মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় ভালো যন্ত্রপাতি আমদানির পক্ষে। তার জন্য বেশি দাম দিতেও রাজি। তা ছাড়া আমরা যে মানের বা দামের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সাহস করি, তা আমাদের দেশের অন্য প্রতিষ্ঠান, এমনকি এশিয়ায়ও নেই।’

তবে ব্যবসার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত না করে সফল ব্যবসায়ী তৈরি করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা গেলে ব্যবসার পরিবেশ অনেকটাই বদলে যাবে।’ দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা করা সম্ভব হলে পণ্য বিক্রির জন্য আমাদের আর বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হবে না।’

আজকের অবস্থানে আসার পেছনে ভাগ্যের সহায়তা কতটুকু? এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমার আজকের অবস্থানের পেছনে ভাগ্যের সহায়তা নেই তা বলব না, আবার শুধু ভাগ্যের কারণেই আমি আজ এ অবস্থায়, তাও আমি মনে করি না। ভাগ্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে সবাই সমান। তবে শুধু লাক বা ভাগ্যের সহায়তায় সব হয় না। ইচ্ছা ও পরিশ্রমই মানুষকে সাফল্য এনে দিতে পারে।’

স্মৃতিকাতর কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘একটা সময় আমি দয়াগঞ্জ থকে ১৬ কেজি ওজনের তেলের টিন মাথায় করে নিয়ে আসতাম। অথচ তখন ১৬ কেজি বহন করার মতো বয়সই আমার ছিল না। আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসত।’

নিজের প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করেন কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশের ১৫ কোটি মানুষ আমার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা। ১৫ কোটি মানুষ যে পণ্য ব্যবহার করছে, আমি কেন তা করব না? আমার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যই আমি ব্যবহার করি।’

সাফল্যের শিখরে উঠেও দৈনন্দিন কাজে শৈথিল্য নেই ফজলুর রহমানের। প্রতিষ্ঠানের সব বিভাগেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। তার পরও ব্যাংকের লেনদেন, কাঁচামাল কেনা ও পণ্য বিক্রির বিষয়গুলো যতদূর সম্ভব নিজেই দেখভাল করেন তিনি। পাশাপাশি পরিবারকেও সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন। সকাল ৭টায় ঘরের সবাইকে নিয়ে নাস্তা সেরে অফিসে রওনা হন। দুপুরের খাবার আসে বাসা থেকে। বাসায় ফিরে সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খান।

সিটি অয়েল মিলসকে একুশ শতকের একটি আধুনিক কম্পানিতে রূপান্তরের জন্য ফজুলর রহমান ঢাকার অদূরে রূপসীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সিটি ভেজিটেবল অয়েল মিলস। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ‘গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’ হিসেবে যাত্রা শুরু হয় সিটি গ্রুপের।

১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিটি গ্রুপের আরো দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসান ভেজিটেবল অয়েল মিলস লিমিটেড ও সিটি ফাইবারস লিমিটেড। কম্পানিতে নতুন কিছু ব্র্যান্ড সংযোজনের পরিকল্পনা থেকে ফজলুর রহমান বাজারে আনেন ‘তীর’ ব্র্যান্ডের ভোগ্যপণ্য।

প্রথম দিকে তীর ব্র্যান্ডের অধীনে শুধু সয়াবিন তেল বাজারজাত করা হলেও একে একে বাজারে আসে তীর মাস্টার্ড অয়েল, তীর কোকোনাট অয়েল, তীর বনস্পতি, তীর আটা, তীর ময়দা, তীর সুজি, তীর লবণ, তীর পোলট্রি ফিড, তীর ফিশ ফিড, তীর সয়ামিল ও তীর রেইপসিড কেক। সিটি গ্রুপের অন্য ব্র্যান্ডগুলো হচ্ছে সান রিফাইন্ড সয়াবিন অয়েল, ন্যাচারাল রিফাইন্ড সয়াবিন অয়েল, সান বনস্পতি ও জীবন মিনারেল ওয়াটার।

 

আপনার মতামত প্রদান করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here