সরকারের নানামুখী কর্মকাণ্ডে দেশ খাদ্য উৎপাদনে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখনও সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। খাদ্য ব্যবসায় জড়িত কিছু অতি মুনাফাকারী এবং ভেজালচক্রের দৌরাত্ম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য ও খাদ্যপণ্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে দেশে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে সুশাসনের ঘাটতিও ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে কর্মক্ষম জনসম্পদের বিকল্প নেই। আর কর্মক্ষম জনসম্পদের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য অপরিহার্য। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাধ্যমে আমাদের জনসম্পদকে স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
খাদ্যে ভেজাল মেশানোর হার বছর বছর বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি সরকারি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারের এক তথ্য প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাজারের কোনো পণ্যে ৬৬ শতাংশ, কোনোটিতে ৪৩, আবার কোনোটিতে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ ভেজাল। দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চালেও ভেজাল মিলেছে প্রায় ৯ শতাংশ। ভেজালের ভিড়ে বেশি এগিয়ে আছে মিষ্টি জাতীয় পণ্য। শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধেও মেশানো হয় নানা রকম বিষাক্ত কেমিক্যাল। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, খাদ্যপণ্যে টেক্সটাইল কেমিক্যাল ও টেক্সটাইল রং, ইউরিয়া, হাইড্রোজ, কার্বাইড, ফরমালিন, প্যারাথিয়নসহ হরেক রকম বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, টেক্সটাইল রং ও কেমিক্যাল খাদ্য বা পানীয়ের সঙ্গে মিশে মানবদেহে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে লিভার, কিডনি, হূৎপিণ্ড ও অস্থিমজ্জার। খাদ্যে ভেজালের কারণে শরীরে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেউলিওর ও হাঁপানি বেড়ে যায়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের কারণে পেটব্যথা, বমি, মাথা ঘোরা, পাতলা পায়খানা, বদ হজম, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, হঠাৎ পালস রেট কমবেশি হওয়াসহ বিভিন্ন রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
দীর্ঘদিন ধরেই অনিরাপদ খাদ্যের কারবারিরা তৎপর থাকলেও তাদের অপতৎপরতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। নানা সময়ে এদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও বিএসটিআইর অভিযান পরিচালিত হলেও কার্যত কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার জরিমানা করার পরও পরবর্তী সময়ে একই অপরাধ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযান বন্ধ হলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
সরকার নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে এবং আইনের আওতায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেছে। ইতোমধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু জায়গায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৭টি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা, দায়িত্ব পালনে গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এরই সুযোগ নিচ্ছে অনিরাপদ খাদ্যের কারবারিরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তাসাধারণ।
খাদ্যে ভেজালকারী ও মুনাফাখোর সিন্ডিকেট একদিকে নানাভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে, অন্যদিকে অনিরাপদ, ভেজাল পণ্য বিক্রি করে জনগণের স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে। এ নৈরাজ্য ঠেকাতে জেলা প্রশাসন, খাদ্য অধিদপ্তর, জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তাদের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয় জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের মূল অংশীজন হলো ভোক্তা। সরকারি নীতিনির্ধারণে এই ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মাঝে বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারণীতে ব্যবসায়ীদের আধিক্য থাকলেও ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব আমলে নেওয়া হয়নি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর সব সময় ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নিলেও ভোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে আগ্রহী নয়। ফলে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে। কর্তৃপক্ষ যদি ব্যবসায়ীনির্ভর হয়ে যায়, তাহলে যাবতীয় নীতি প্রণীত হবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। যা খাদ্যপণ্যের বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায় হবে এবং চলমান ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের বৈষম্যকে আরও উস্কে দেবে।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত খাদ্যে ভেজালকে দুর্নীতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল এবং অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রয়কে ‘দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করবে। এর পরও স্থান-কাল-পাত্রভেদে আইন প্রয়োগের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দেখা যাচ্ছে। প্রভাবশালী ও বড় ব্যবসায়ীদের বেলায় আইন প্রয়োগে শিথিলতায় এর মূল উদ্দেশ্য বারবার ব্যাহত হচ্ছে। বাহারি ও চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে খাদ্যপণ্য ক্রয় করলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ভোক্তা ও কোমলমতি শিশুদের মাঝে সচেতনতা বিকাশে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ছাড়া পাঠ্যবইয়ে নিরাপদ খাদ্যপণ্য, ভোক্তা অধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাহলে আজকের প্রজন্ম বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা হিসেবে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত হতে পারবে।
এসএম নাজের হোসাইন
ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nazer@gmail.com