নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা, টেকনিক্যাল ও টেস্টিং সুবিধার অপর্যাপ্ততা এবং পিটিএ ও এফটিএ’র অনুপস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগান যাচ্ছে না। শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) যৌথভাবে আয়োজিত ইনভেস্টমেন্ট সামিটের ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এবং বাংলাদেশ : অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। ওয়েবিনারে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান এসব কথা বলেন।
এছাড়া ভৌগোলিক দিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং এখানকার বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক নীতিমালার সংস্কার ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন, পণ্য বহুমুখীকরণ, কর ও শুল্ক কাঠামোর আধুনিকায়ন, অবকাঠামোখাতের উন্নয়ন, ক্রড বর্ডার বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি একান্ত অপরিহার্য বলে মত দেন আলোচকরা।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, “এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৫০ ভাগই আসে এ অঞ্চলের দেশসমূহ হতে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে ২০২১ সালে ২৩৯.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিনিয়োগ এসেছে এবং মূলত খাদ্য, কৃষি, ফিশারীজ, কেমিক্যাল, টেক্সটাইল, তৈরি পোষাক, সিমেন্ট, নির্মাণ, টেলিকম, ইন্স্যুরেন্স ও ব্যাংকিং প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা, টেকনিক্যাল ও টেস্টিং সুবিধার অপর্যাপ্ততা এবং পিটিএ ও এফটিএ’র অনুপস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, ‘এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশ এবং এই সুযোগকে কাজে লাগাতে আমাদেরকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের বেসরকারিখাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বেসরকারিখাত হতে উত্থাপিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক প্রতিবন্ধকতাসমূহ সম্পর্কে সরকার অবগত রয়েছে, সেগুলো দ্রুত নিরসনে সরকার বন্ধ পরিকর। সরকার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার করেছে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে শিল্প-কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে। টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিতে হবে।’
ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘সরকারের ক্রমাগত নীতি সহায়তার ফলে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে তা অব্যাহত থাকবে। দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ইতোমধ্যে মেগা প্রকল্পসমূহসহ অন্য প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১টি দেশের সাথে পিটিএ স্বাক্ষর করেছে এবং ১০টি দেশের সাথে পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং আশা প্রকাশ করেন, অতি দ্রুতই ২টি দেশের সাথে পিটিএ স্বাক্ষর হবে।’
ইতো নায়োকি বলেন, ‘আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৩০০০ মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়বে এবং বাণিজ্য ও সেবার খাতের সম্প্রসারণের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাংলাদেশের চলমান অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের কাজ যথাযথ সময়ের মধ্যে সম্পন্নকরণ এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে সকল ধরনের সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিতকরণের ওপর জোরারোপ করেন। কোভিড মহামারী সত্ত্বেও গত অর্থবছরে জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০ শতাংশ বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, পণ্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর জোরারোপ করা আবশ্যক। নীতিমালা সংস্কার ও সহজীকরণের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধি পাবে, যার মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে। ঢাকার অদূরে আড়াইহাজারে স্থাপিত ‘জাপান ইকোনোমিক জোন’-এ ১০০টি কোম্পানির শিল্প-কারখানা স্থাপনের সুযোগ রয়েছে এবং আশা প্রকাশ করে এ শিল্প অঞ্চলটি পুরোপুরি চালু হলে বাংলাদেশ আরও বেশি হারে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে, সেই সাথে বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজ বৃদ্ধি পাবে।’
ওয়েবিনারে নির্ধারিত আলোচনায় পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ, এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির এবং ইউএনএ্যাসক্যাপ-এর ডেপুটি হেড ও সিনিয়র ইকোনোমিক অফিসার ড. রজন সুরেশ রত্না প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠীই আমাদের প্রধান শক্তি যা কাজে লাগাতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে সরকারের ধারাবাহিকতা ও নীতি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, জটিল কর ও শুল্ককাঠামো, ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ব্যবসায় ব্যয় বাড়ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে এফটিএ এবং পিটিএ স্বাক্ষরে সরকারের আরও উদ্যোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণে গুরুত্ব দিতে হবে।’
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো হতে বিনিয়োগ আকর্ষণে আরও মনোযোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিতে হবে। যথাসময়ে নীতিমালার বাস্তবায়ন ও নীতিমালার সহজীকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে এনবিআর পক্ষ হতে সহযোগিতা প্রদান, ঢাকা বিমানবন্দরে পণ্য আদান-প্রদানে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও দ্রুতকরণ এবং বিমান বাংলাদেশের সেবার আধুনিকায়নের ওপর জোর দিতে হবে।’
ইউএনএ্যাসক্যাপ-এর ডেপুটি হেড ও সিনিয়র ইকোনোমিক অফিসার ড. রজন সুরেশ রত্না বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি পণ্য ও এক অঞ্চলের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরতা এলডিসি উত্তোরণের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলতে পারে, তাই রপ্তানি পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণ অতীব আবশ্যক। ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে প্রচুর খরচ বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়া-অঞ্চলের দেশসমূহে আরও বেশি হারে পণ্য রপ্তানির ওপর নজর দেয়া আবশ্যক। আঞলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে তিনি অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, ক্রস বর্ডার যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় প্রয়োজনীয় অনুমোদনপত্র প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিলতা নিরসন দ্রুত করতে হবে।’
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেন, ‘এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা কাজে লাগাতে পার্টনারশীপ ও গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে উন্নয়ন দরকার, যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে ও পণ্য উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে।’
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘সারা পৃথিবীর ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বসবাস করে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জিডিপি’র ৫০ শতাংশ আসবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল হতে। এমতাবস্থায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে আমাদের সরকার ও উদ্যোক্তাদের আরও কৌশলি হতে হবে।’