দেশের বাজারে ইলিশের দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। বছরের এই সময়ে ইলিশের দাম যেমনটা হওয়ার কথা, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে ইলিশ এখন জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বর্তমানে ওজনে ২ কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি সাড়ে ১৭শ’ টাকা থেকে ১৮শ’ টাকা। অথচ এক মাস আগেও এই আকারের ইলিশের দাম ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ হাজার টাকার নিচে ছিল।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে মাছের সংকট থাকার কারণে দাম বেড়েছে। অপরদিকে কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানি হওয়ার কারণে দেশের বাজারে ইলিশের সংকট দেখা দিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ইলিশ আমদানি করার কারণে ভারতে ইলিশের দামে ধস নেমেছে। দেশটিতে কয়েকদিন আগে যে ইলিশ ১৮শ’ টাকায় বিক্রি হতো সেই ইলিশ ১২শ’ টাকায়ও কেউ কিনছেন না।
এদিকে জেলেরা জানিয়েছেন, দেশে ইলিশের মৌসুম আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত নদী বা সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়েনি। একজন জেলে সারাদিন যে পরিমাণ মাছ ধরতেন তার চেয়ে অর্ধেক মাছ ধরছেন সারাদিনে। এক দিনে যে পরিমাণ খরচ হয় ট্রলারে তার চেয়ে অর্ধেক দামের মাছ পান তারা। এতে লাখো জেলের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার (১ অক্টোবর) কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, মাত্র ৪ থেকে ৫ জন ব্যবসায়ী ইলিশ বিক্রি করছেন। তাদের ঝুড়িতে খুব বেশি ইলিশ নেই। তবে যতটুকু আছে সেগুলোও বিক্রি হচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহে যে পরিমাণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে তার অর্ধেক ইলিশ বিক্রি হয়েছে শুক্রবার ।
কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা মো. মিলন হোসেন জানান, দুই কেজি সাইজের ইলিশ সাড়ে ১৭শ’ টাকায়, দেড় কেজিরগুলো ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকায়, এক কেজি সাইজের ইলিশ প্রতিকেজি বিক্রি করছেন ১২শ’ টাকায়। এছাড়া ৭শ’ গ্রামের ইলিশ ৮শ’ টাকা ও তার চেয়ে আরও ছোট ইলিশ ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা কেজিতে নবিক্রি করছেন।
ইলিশের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে মিলন হোসেন বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সংকট হয়েছে ভারতে রপ্তানি শুরু হওয়ায়। কারণ আড়ত থেকে যখন ভারতে চলে গেছে মাছ তখন আমরা আড়তে গিয়ে মাছ বেশি পাচ্ছি না। যতটুকু পাচ্ছি সেগুলো বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তার মধ্যে থেকে কেজিতে ৫০ টাকা লাভ করে বিক্রি করছি।’
২০১২ সাল থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ ছিল। এরপর ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৫০০ টন ইলিশ রপ্তানির মধ্যে দিয়ে ফের দেশটিতে ইলিশ রপ্তানি শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে ১৪৫০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেয় সরকার।
এবার এর অনুমোদন আরও বাড়িয়ে করা হয় ২০০০ টন। ১০ অক্টোবরের মধ্যে ৫০ জন ব্যবসায়ী ৪০ টন করে মোট ২০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি পান। এবার কি পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে সেই তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, ইতোমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়েছে।
চাঁদপুর ও বরগুনায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ভারতে ইলিশ রপ্তানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে কয়েক দফায় রপ্তানি হয়েছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেখানে ইলিশের দাম অর্ধেকে নেমেছে, তবুও ক্রেতা পাচ্ছেন না সেখানকার ব্যবসায়িরা। অর্থাৎ আমদানি করা বাংলাদেশের ইলিশের প্রভাবে দাম কমেছে সেখানে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব মেদিনীপুরে ২ কেজির বেশি ওজনের ইলিশ কিছুদিন আগে বিক্রি হচ্ছিল ১৮শ’ টাকা কেজিতে। এখন সেই ইলিশের দাম নেমেছে ১২শ’ টাকায়, কিন্তু তাতেও ক্রেতা নেই। ব্যবসায়িরা আরও দাম কমিয়ে ইলিশ বিক্রি করছেন।
তাহলে বাংলাদেশের ইলিশ আমদানি করার কারণে ভারতে ইলিশের দাম কমলো এবং বাংলাদেশে দাম বেড়ে গেল?- এই বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার রপ্তানিকারকরা জানান, আজ বা কালের মধ্যে ইলিশ রপ্তানি হয়নি। আগে কয়েক দফায় রপ্তানি হয়েছিল। তারা হয়তো সেই ইলিশগুলো বিক্রি করছেন।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বাজারে ২ কেজি ওজনের ইলিশের দাম প্রতিকেজি প্রায় ১৮শ’ টাকা। আর একই ইলিশ ভারতের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২শ’ টাকায়। তাহলে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে লাভ করে কিভাবে ভারতের ব্যবসায়িরা?
এই বিষয়ে রপ্তানিকারকরা জানান, তারা ভারতে রপ্তানি করে গড়ে দাম পেয়েছিল ৯শ’ টাকা প্রতিকেজিতে। এর মধ্যে দুই কেজি ওজনের ইলিশও ছিল, আবার এককেজি, দেড় কেজিরও ছিল। সেই ইলিশ ভারতের ব্যবসায়িরা গ্রেডিং করে বিভিন্ন দামে বিক্রি করছেন। যেহেতু তারা ৯শ’ টাকা কেজি করে ইলিশ আমদানি করেছিল তাই বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারছেন বলে জানান তারা।
রপ্তানি ছাড়াও এবার ইলিশের উৎপাদন অনেক কম বলে জানান চাঁদপুর মৎস সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল বারি জমাদার মানিক।
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময় শুরু হয় পূর্ণিমার পাঁচদিন আগে। এরপর চলে মোট ২২ দিন। সেই হিসেবে আমরা ধারণা করেছিলাম অক্টোবরের ১৪ থেকে ১৫ তারিখে নিষিদ্ধ সময় আসবে। কিন্তু এবার সরকার নিষিদ্ধের সময় দিল ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। আমরা ১৪ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত মাছ ধরতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়তো।’