পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ‘কাগুজে প্রতিষ্ঠানের’ নামে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের নেতৃতে ঋণ আবেদন করা হয়েছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স জয়েন্ট স্টক (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর) থেকে নেয়া হয়।
কাগুজে এসব প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে নেয়া হয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেরও (বিএসইসির) সহযোগিতা। কোম্পানির ধরন যাচাই না করে জয়েন্ট স্টকের কর্মকর্তারা যেমনি লাইসেন্স দিয়েছেন, তেমনি বিএসইসিও যাচাই না করে এসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত করেছেন। যার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিকে হালদার পুঁজিবাজারের চার প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দুদকের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় সাবেক সিনিয়র সচিবসহ ৭৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন টিম এসব মামলা করছে। পিকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে সহযোগিতা করায় জয়েন্ট স্টক এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুদক।
এ ছাড়া ঋণের নামে অর্থ লুটপাটে সহযোগিতা করার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও উ পরিচালক শাহ-আলমসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু পদস্থ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে নোটিশ পাঠিয়েছে দুদক।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, জয়েন্ট স্টকের কাছে পিকে হালদারের লুটপাট-সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে পত্র দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, দ্রিনান অ্যাপারেলস লিমিটেড, লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, ওকায়ামা লিমিটেড।
এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পেতে দাখিলকৃত আবেদনের কপি ও এর সঙ্গে সংযুক্ত রেকর্ডপত্রাদি, অডিট প্রতিবেদন, বার্ষিক প্রতিবেদন, ফাইন্যান্সিয়ল স্টেটমেন্ট ও ইনকাম স্টেটমেন্ট, এজিএম ও কোম্পানি ফাংশন-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রসহ উক্ত কোম্পানির প্রথম নিবন্ধন থেকে শুরু করে সর্বশেষ নিবন্ধন পর্যন্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্রাদি।
দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে দুদক এখন পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা লুট করার অভিযোগে ১৫টি মামলা করেছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে পিকে হালদার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং ঋণগ্রহীতাদের; যারা পিকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এফএএস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থ কীভাবে কার মাধ্যমে গেছে, তা এখনও অনুসন্ধান চলছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এসব মামলায় ১৫ জন গ্রেপ্তার করেছে দুদক; যার মধ্যে অধিকাংশ দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতিতে পিকে হালদার তার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের ব্যবহার করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদেরকে বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিক বানিয়ে ঋণ হাতিয়ে নিলেও তারা ছিল তার বেতনভুক্ত কর্মচারীর মতো। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি মো. রাশেদুল ইসলাম ও পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন যে, তারা সবাই পিকে হালদারের বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিল।
এদিকে এফএএস ফাইন্যান্স এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক। ইন্টারন্যাশাল লিজিং থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ১৫ মামলার পর এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ১৩শ’ কোটি এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে দুদুক আরও ২০টি মামলা করতে যাচ্ছে।
২০ মামলায় পিকে হালদার ছাড়াও আসামি হচ্ছেন এফএএস ফাইন্যান্সের পরিচালক সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আতাহারুল ইসলাম, পিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান, এফএএস ফাইন্যান্সের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক পরিচালক উজ্জ্বল কুমার নন্দী, ধীরেন্দ্র কুমার সোম, এম এ হাফিজ, সোমা ঘোষসহ ৭৫ জন। এ ছাড়া পিকের বান্ধবী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদ রুনাই, সাবেক এমডি আবেদ হাসান, মো. রাশেদুল হক, পিকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাসুদেব ব্যানার্জী, রাজিয়া ব্যানার্জী, নওশেদুল ইসলাম মো. নুরুল ইসলামসহ সব পরিচালককেও আসামি করে মামলা হচ্ছে।
দুদক অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে ২০১৪ সালের শেষের দিকে পিকে সিন্ডিকেট শেয়ার ক্রয় করে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ হাত নেয় এবং কৌশলে পুরাতন কর্মচারীদের ছাটাই করে তাদের পছন্দমতো কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করেন।
রাসেল শাহরিয়ারকে এমডি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। রাসেল শাহরিয়ার হলো পিকে হালদারের পূর্বপরিচিত এবং ২০০৭ সালে তারা একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিল। মূলত উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার পছন্দমতো পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ দেন। সিদ্দিকুর রহমান এবং জাহাঙ্গীর আলম হলেন পিকে হালদারের বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার। সে সুবাদে ফাস ফাইন্যান্সের দায়িত্ব পড়ে সিদ্দিক ও জাহাঙ্গীরের হাতে। অস্তিত্বহীন কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে হবে এ সিদ্ধান্ত আগেই পিকে হালদার দিয়ে দিতেন। লোক দেখানো বোর্ড মিটিং হতো এবং বোর্ডে এমডি ডেকে বলে দেয়া হতো এসব বোর্ডের ফাইল এবং দ্রুত ঋণের ব্যবস্থা করো।
রাসেল শাহরিয়ার সুবোধ বালকের মতো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাচাই ছাড়াই এবং কোন মর্টগেজ না নিয়ে তার একক স্বাক্ষরে ক্রেডিট মেমো প্রস্তুত করে বোর্ডে উপস্থাপন করে ঋণ অনুমোদন করে নিতো এবং ঋণের অর্থ পিকে সিন্ডিকেটের হিসাবে পাঠিয়ে দিতো। এভাবে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয় যার কোন অর্থ উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের হিসাবে যায়নি। ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠান হলো-এসএ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টার ন্যাশনাল লিমিটেড, সুখাদা প্রোপার্টিজ লি., ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং লি., নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লি., মেসার্স বর্ন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, অ্যান্ড বি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট লি:, আর্থস্কোপ, এমটিবি মেরিন।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে ফাস ফাইন্যান্স থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়া পিকে হালদারের ২২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০ টিই কাগুজে ও অস্তিত্বহীন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। ২টি প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া গেলেও তাও বন্ধ।
পরবর্তীতে, এফএএস ফাইন্যান্সের সহকারী ম্যানেজার মো. নুরুল আমিনের নেতৃত্বে চার সদস্যেও একটি টিম দুই সপ্তাহ সরেজমিনে পরিদর্শন করেও ২০টি প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় খুঁজে পায়নি। ঋণ নেয়া ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও তাদের বাসায় থাকেন না বা বিদেশে পলাতক করেছেন। সবার মোবাইল নম্বর বন্ধ রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণের টাকা আদায়ের আর কোন সম্ভাবনা নাই।
দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন ব্যাংকের লেয়ারিং-সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ২০টি ব্যাংকে পত্র দিয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তা। জয়েন্ট স্টকে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের গাফলতির কারণে পিকে সিন্ডিকেট ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স নিয়ে লিজিং থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের সুযোগ পেয়েছে। এবার দুদক সেসব কর্মকর্তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে।