বিজ্ঞাপন – শব্দটি শুনলে আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই বিরক্তি আর আকর্ষণ মিলে একটি মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়৷ কোনো টিভি অনুষ্ঠানের মাঝে এই জিনিসটা হাজির হলে আমাদের বিরক্তির সীমা থাকে না৷
কারণটা জানা, এখন অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন নয়, যেন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান দেখতেই বেশি অভ্যস্ত আমরা!
শুধু টেলিভিশনেই না, বর্তমানে পত্রিকাগুলোর সামনের-পেছনের পৃষ্ঠায় বিশাল অংশজুড়ে বিজ্ঞাপন থাকা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ভেতরের পাতায়ও যেখানে সেখানে থাকে অসংখ্য বিজ্ঞাপন৷ মাঝে মাঝে তো বিজ্ঞাপনের অভিনব কৌশলে সংবাদ থেকে তাকে আলাদা করতেও বিপাকে পড়তে হয়৷ আর অনলাইনের তো কথাই নেই৷ ওয়েবসাইটের মূল আধেয়র চারিদিকে থাকার পাশাপাশি যেখান সেখান দিয়ে হুট করে হাজির হচ্ছে বিজ্ঞাপন৷
তবে বিরক্তির পাশাপাশি বিজ্ঞাপন আমাদের বিভিন্ন পণ্য ও সেবা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় (এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রচুর অপ্রয়োজনীয়) তথ্য এনে দেয়, যা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে৷ এছাড়াও অনেক বিজ্ঞাপনই আমাদের কাছে ভালোমন্দ নানারকম বার্তা তুলে ধরে, যা আমাদের আকৃষ্ট করে, আমাদের আবেগ আর লুকানো চাহিদাকে নাড়া দেয়৷ আবার কিছু কিছু বিজ্ঞাপনের শিল্পগুণ আমাদের মুগ্ধ করে৷ সেসব বিজ্ঞাপন আমরা গণমাধ্যমের অন্যান্য আধেয়র মতোই সাদরে গ্রহণ করি৷
বিজ্ঞাপন একটি মার্কেটিং বা বিপণন কৌশল, যার মাধ্যমে যে কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়৷ বিজ্ঞাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য পণ্য বা সেবা সম্পর্কে জানিয়ে মানুষের চাহিদাকে বাড়িয়ে দেয়া, যেন আগে প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, বিজ্ঞাপনটির মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি সেটি কেনার প্রয়োজন বোধ করেন৷
আধুনিক বিজ্ঞাপনের জনক বলে খ্যাত টমাস যে ব্যারেট বলেছেন, ‘‘রুচি পালটায়, ফ্যাশন পালটায়, আর বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই পালটাতে হবে৷ এমনটা নয় যে প্রতিবারই নতুন আইডিয়া পুরনো আইডিয়ার চেয়ে ভালো হবে৷ কিন্তু তা অবশ্যই পুরনোটার চেয়ে ভিন্ন এবং তা বর্তমান রুচির সঙ্গে মিলবে৷” আবার ২০ শতকের শুরুর দিকে প্রখ্যাত মার্কিন মনোবিদ ওয়াল্টার ডি স্কট এবং জন বি ওয়াটসন বলেছিলেন, মানুষের মৌলিক আবেগগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অনেক বেশি কার্যকর বিজ্ঞাপন তৈরি সম্ভব৷
কিন্তু সেই অভিনবত্ব দেখাতে আর মানুষের আবেগকে ব্যবহার করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন যদি হয়ে পড়ে নীতিবিরুদ্ধ?
এমনটাই যেন চোখে পড়ছে বেশি৷ বিজ্ঞাপনে পণ্য বা সেবা সম্পর্কে বাড়িয়ে বলাটা একটা বৈশ্বিক ট্রেন্ড৷ কিন্তু যে জিনিসে যা হয় না তা বলে, এমনকি শিশুখাদ্য বা পানীয় নিয়েও মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রির প্রবণতা মনে হয় এই উপমহাদেশে বেশি লক্ষ্যণীয়৷ বাচ্চাদের হেলথ ড্রিংকগুলোর কোনোটি শিশুকে তিনগুণ দ্রুত লম্বা করছে, কোনোটি এক কাঠি বেড়ে একই সঙ্গে ‘টলার, স্ট্রংগার ও শার্পার’ করছে, কোনোটি আবার এসবের কাছে না গিয়ে শিশুকিশোরদের স্ট্যামিনা বাড়ানোর দাবি করছে৷ সবগুলো বিজ্ঞাপনেই এই পুষ্টিগুণগুলো ‘বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত’ দাবি করা হলেও হেলথ ড্রিংকের এ জাতীয় বিজ্ঞাপন পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নিষিদ্ধ৷ কেন? কথায় বলে, বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই নাকি যথেষ্ট৷
গণমাধ্যম সম্পর্কে থাকা হরেক তত্ত্বের কোনোটি বলে, গণমাধ্যমে মানুষ যা দেখে বা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে৷ আবার কোনো তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ গণমাধ্যম থেকে সেই কনটেন্ট বা আধেয়টাই গ্রহণ করে যেটা সে গ্রহণ করতে চায়৷ কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, গণমাধ্যমের আধেয় যেমন সমাজকে প্রতিফলিত করে, তেমনি আধেয়টির দর্শক-শ্রোতাকে কমবেশি প্রভাবিত করার সুযোগ থাকবেই, যার প্রতিফলন হবে সমাজের ওপর৷ বিজ্ঞাপনও এমনই একটি আধেয়৷ ফলে বিজ্ঞাপনে প্রচারিত ভুল বার্তা উদ্বেগের কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক৷
একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই: কোনো এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপনে নাকি বলেছিল, এটা খেলে ব্রেইন খোলে, সতেজ থাকে৷ তাই এক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি কারও নিষেধ না শুনে চোখের সামনেই তাঁর মাত্র স্কুলজীবন শুরু করা বাচ্চা ছেলেটাকে এনার্জি ড্রিংক কিনে খাওয়ানো শুরু করলেন! টানা কয়েক মাস বোঝানোর পর ধীরে ধীরে তিনি নিমরাজি হয়ে এ কাজ বন্ধ করলেন ঠিকই৷ কিন্তু ততদিনে বাচ্চাটাকে সেই এনার্জি ড্রিংক আসক্তির মতো ধরে ফেলেছে৷
বিজ্ঞাপনের ভুল বার্তা বা মিথ্যা তথ্যের প্রভাবের এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের চারপাশে রয়েছে৷ ওপরের উদাহরণটি শারীরিক স্বাস্থ্য বিষয়ক৷ মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অগুণতি ভুল বার্তা আমরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন থেকে হজম করছি৷ একটা মেয়েকে ভালো বিয়ে থেকে শুরু করে ভালো চাকরি, সবকিছুর জন্য ফর্সা হতে হবে৷ শ্যামবর্ণের মেয়েদের কপালে চাকরিও নেই – বিজ্ঞাপনের এমন ধারণা চোখ বুজে বিশ্বাস করে আমরা আয়ুর্বেদিক থেকে শুরু করে টিউবলাইট-লেজারলাইট ফর্মুলাযুক্ত রং ফর্সাকারী ক্রিম নিজে মাখছি, অন্যকে মাখার পরামর্শ দিচ্ছি৷ এখন তো পুরুষদের জন্যও আলাদা ফেয়ারনেস ক্রিম আছে৷ যাক, নেতিবাচকভাবে হলেও অন্তত এই একটি দিক থেকে লৈঙ্গিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন কতিপয় বিজ্ঞাপন নির্মাতা!
শুধু তাই নয়, স্থূলতা মানেই হাস্যকর, অপমানজনক – নিজের পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে এমন বার্তা দেয়া বিজ্ঞাপনকে হাস্যরসের ছলে স্বাগত জানাচ্ছি আমরা৷ এর মধ্য দিয়ে দিনকে দিন বর্ণবাদ ও বাহ্যিক রূপকে যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আমরা ‘এগিয়ে’ চলেছি৷
বিজ্ঞাপন ও ক্রোড়পত্র নীতিমালায় সংক্ষেপে বলা থাকলেও বিজ্ঞাপন বিষয়ক নৈতিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে মূলত আলোচনা রয়েছে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪’-তে৷ সেখানে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনে এমন কোনো বর্ণনা বা দাবি প্রচার করা যাবে না, যাতে শিশু থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সের জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হতে পারে৷ বিজ্ঞাপনে নোংরা ও অশ্লীল শব্দ, উক্তি, সংলাপ, জিঙ্গেল, গালিগালাজ ইত্যাদিও থাকা যাবে না৷ শুধু তাই নয়, দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, শিশু-কিশোর ও যুবসমাজের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে এবং সংস্কৃতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এমন কোনো বিজ্ঞাপনও প্রচার করা যাবে না৷ পাশাপাশি শ্রমের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন ধারণাকেও বিজ্ঞাপন থেকে বাদ দিতে হবে৷ শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা বা দৈহিক আকার-বর্ণকে কেন্দ্র করে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার নিষেধ৷
শিশুদের চরিত্র গঠনে সুশিক্ষা প্রদানের মতো বার্তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়৷ শিশুর নৈতিক, মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না৷ যে কোনো খাদ্য বা পানীয়ের বিজ্ঞাপনে এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতেও এই নীতিমালায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ নারী, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিকারী আধেয়র পাশাপাশি সংশ্লিষ্টতা ছাড়া বিজ্ঞাপনে নারীর অহেতুক ও দৃষ্টিকটু উপস্থাপনও পরিহার করতে বলা হয়েছে৷ এমনি আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার চতুর্থ অধ্যায়ে৷
কিন্তু এর কয়টা মানা হচ্ছে আমাদের দেশে?